ডেস্ক রিপোর্ট ,বাংলারিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকম কথাশিল্পী সোমেন চন্দ প্রকৃতপক্ষে কমিউনিস্টঘরানার আদর্শকে মনে-প্রাণে মেনে নিয়েছিলেন। বিপ্লবী সোমেন ১৯২০ সালের কোনো এক শুভ তিথিতে নরসিংদীর মনোহরদী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে কখনো গ্রামাঞ্চল আবার কখনো শহরে। গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে ভর্তি হন মেডিকেল কলেজে এবং কমিউনিস্ট পার্টির বিপ্লবী জীবনাচরণ শুরু হয়। বিপ্লবী চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে ছোটগল্প লেখা শুরু করেন। মাত্র ২১-২২ বছরের জীবনে হাতে গোনা কয়েক বছর সাহিত্যচর্চার সুযোগ পান। ছোটগল্পের পাশাপাশি ‘বন্যা’ নামে একটা উপন্যাসও লিখেছিলেন। ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ বিপ্লবী এই গল্পকার নির্মমভাবে শহীদ হন। জাতীয়তাবাদী ও ফ্যাসিবাদ সমর্থকরা প্ররোচিত নৃশংস হামলায় ঢাকায় প্রকাশ্য রাজপথে দানবীয় উল্লাসে সোমেনকে হত্যা করে। মিছিলের ভেতর ফ্যাসিবাদের দোসর গু-ারা মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সোমেনের ওপর হামলা চালায়, উপর্যুপরি আঘাতে তারা মাটিতে ফেলে চোখ উপড়ে নেয়, জিহ্বা টেনে বের করে কেটে ফেলে, পেটের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যায়, তারপর তার দেহের ওপর উগ্র পিশাচরা নৃত্য শুরু করে। এভাবেই একজন সাহিত্যিকের মৃত্যুু হয় ফ্যাসিবাদীদের হাতে। আমরা জানি এরই মধ্যে সোমেন চন্দ ‘সংকেত ও অন্যান্য গল্প’ এবং ‘বনস্পতি ও অন্যান্য গল্প’ নামে দুটো গল্পগ্রন্থ তৈরি করে রাখেন, যদিও তা প্রকাশ হয় মৃত্যুর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪৩ সালে। ২৫টি ছোটগল্প, ‘আগুনের অক্ষর’ এবং ‘বন্যা’ নামে দুটো উপন্যাস, দুটো একাঙ্কিকা, তিনটি গদ্য কবিতার রচয়িতা সোমেন যে বাংলা সাহিত্যের অসামান্য কথাশিল্পী এবং উজ্জ্বল নক্ষত্র, তা তার সাহিত্যকর্মে লক্ষ্য করা যায়, স্বল্পসংখ্যক সাহিত্যভা-ারের জনক হলেও তার গল্পের শিল্পসৃষ্টির জন্য তিনি বাংলা সাহিত্যের মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। তার নির্মম হত্যা সারা দেশের প্রগতিশীল মানুষের মনে প্রচ- আঘাত দিয়েছিল, বিশেষ করে কবি-সাহিত্যিকরা এ হত্যাকে সহজে মেনে নিতে পারেননি। কবি বুদ্ধদেব বসু ‘প্রতিবাদ’ নামে একটা দীর্ঘ কবিতা লেখেন তাকে স্মরণ করে, কবি সমর সেনও কবিতা লেখেন। সোমেনের গল্পের জগৎ থেকে কয়েকটি গল্প নিয়ে একটু আলোচনা করলে দেখব জীবনকে কতটা কাছ থেকে দেখেছেন, সমাজবিজ্ঞানীর চোখ দিয়ে মধ্যবিত্ত জীবনের সমগ্র খুঁটিনাটি বিষয় বিশ্লেষণ করেছেন। তার সমস্ত গল্প নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায়, নানান রসে নানান উপাদানে ভরপুর, যা সবই জীবন থেকে নেয়া। গল্পের বিষয়ে যেমন চমৎকারিত্বের পরিচয় বহন করে, ব্যাপ্তি বা শিল্পকাঠামো অথবা ভাষাশৈলী সবখানেই সোমেনের স্বাতস্ত্র্যতা লক্ষ্য করা যায়। তার গল্পে জীবনের খ- খ- অংশগুলো চিরন্তনভাবে প্রতিভাত হয়েছে। জীবনের প্রতি মুহূর্তকে যেমন সঠিকভাবে এনেছেন তেমনি প্রতি ক্ষুদ্র অংশকে সোমেন বিষয়ের ছাঁদে অঙ্কন করেন। হয়তো কখনো তা বিন্দুকে সিন্ধুতে রূপান্তরিত করেছেন অথবা সিন্ধুকে অবলীলায় বিন্দুতে রূপায়ণ করে গল্পের চমৎকারিত্বের বিমূর্ত ছবি এঁকেছেন; তাতে গভীরতার সিন্ধু আরো খানিক বৃদ্ধি পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের যে তত্ত্ব, ছোট কথা, ছোট ব্যথা… নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ… শেষ হয়েও হইল না শেষ সেখান থেকে সরে এসে নরেন্দ্রনাথ মিত্র বলছেন, ‘ছোটগল্প মানে কিন্তু সেই অর্থে ছোট নয়, সূক্ষ্ম বুদ্ধির বিকাশ, ছোটগল্পে হাজার পাখি এবং হাজার হাজার ফুল, একেক ফুলের যেমন একেক রকম গন্ধ, তেমনি একেক পাখির একেক রকমের ডাক, সব মিলিয়ে বন এবং আমাদের জীবন।’ মোট কথা জীবনের একটা অংশকে ছোটগল্পের ক্যানভাসে পরিপূর্ণতার সঙ্গে তুলে ধরাই ছোটগল্প রচয়িতার মোক্ষম কাজ, যে কাজটা সোমেন চন্দ সার্থকভাবেই পেরেছেন, নিজস্ব শৈলী বা স্টাইল তার গল্পের ভুবন সমৃদ্ধ করেছে।
‘সত্যবতীর বিদায়’ গল্পে সোমেন চন্দ কুসংস্কার আর অশিক্ষার বিরুদ্ধে কুঠারাঘাত করেছেন ‘ভূত-ভয়-ভগবান’ বলে যে বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই এবং এসবই শুধু সংস্কার; সেই সংস্কারকে যে সমূলে নিকেশ করাই ছিল গল্পের বিষয়, পারিবারিক একটা বিষয়াদির ওপর গল্পটির কাঠামো দাঁড়িয়ে থাকলেও মূলত গল্পটি প্রতীকধর্মী। সত্যবতীর বেশি দিন ঠাঁই হয়নি রাজু অর্থাৎ রাজকুমারের বাড়ি, কারণ ঐ মা-কালী ভক্তি বা তার আশীর্বাদে পাওয়া, ভূতের গল্প শুনিয়ে বাড়ির কচিকাঁচা ছেলেপেলেদের ভূতাঙ্ক করে তোলা, মানুষজনকে ছোট-বড় জ্ঞান না করে অপমান-অপদস্থ করা এতটাই বাতিকে পরিণত হয় যে বাড়ির লোকেরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। গল্পে কিছু কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের বিশ্বাসের ঘরে যে আঘাত সোমেন করেছেন এবং সাহিত্যে ফুটিয়ে তুলেছেন, এক কথায় অবশ্যই তা চমৎকার। রাজকুমারের পিতা নবকুমারের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী সত্যবতী, বড়ই মুখরা এবং বিদঘুটে কালো, কুসংস্কারের আধার, দীর্ঘকাল পরে সৎ ছেলের বাড়ি এলেও ঠাঁই সে করে নিতে পারেনি, কয়েক দিনের মধ্যে বাড়ির লোকদের জ্বালিয়ে আবার নতুন গন্তব্যে পাড়ি দেয়, হয়তো শেয়ালদায় তার কোনো আত্মীয় আছে। সোমেন এখানে বোঝাতে চেয়েছেন যে মানুষের প্রতি বিতৃষ্ণা বা ঘৃণা থাকলে তার কোনো গতি হয় না, সেই আজন্মকাল উপেক্ষিত থেকে যায় মানুষের চোখে। সংস্কার-কুসংস্কার বড় কথা নয়, বড় কথা হলো মানুষকে ছোট বা ঘৃণা করা যে মহাপাপ এবং সে পাপের কোনো ক্ষমা নেই, ‘সত্যবতীর বিদায়’ গল্পের মধ্যদিয়ে জীবন সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা জন্মে। সত্যবতী একজন কুসংস্কারাচ্ছন্ন নারী, অশিক্ষার ফলে যে অমানবিকতা তারই ফলাফল ধর্মান্ধতা, মানুষকে ছোট-নীচ ভাবার জ্ঞান, সোমেন পাঠককে সেই কূপম-কতা থেকে বেরিয়ে আসার যে মন্ত্র দিয়েছেন, তাতেই স্পষ্ট বোঝা যায় মানুষকে কোনো কোনো সময় মানুষের বৃহৎ সমাজে ফিরে যেতে হয় এবং সেখানেই তার প্রকৃত সাফল্য।
‘লোকটি খুব তাড়াতাড়ি পল্টনের মাঠ পার হচ্ছিল, বোধ হয় ভেবেছিল, লেভেল-ক্রসিং-এর কাছ দিয়ে রেলওয়ে ইয়ার্ডে পড়ে নিরাপদে নাজিরাবাজার চলে যাবে, তার হাতের কাছে বা কিছু দূরে একটা লোকও দেখা যায় না। ‘দাঙ্গা’ গল্পটি শুরু হয়েছে ঠিক এভাবেই, দাঙ্গার একটা ভয়াবহ চিত্র এখানে অঙ্কিত হয়েছে সাবলীলভাবে, ঢাকার চলমান পরিস্থিতি এবং দাঙ্গার একটা সময়কে অবলম্বন করে সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্পটি বাংলা সাহিত্যে মাইলফলক হিসেবে মোটা দাগে দেখানো হয়। কিন্তু সোমেনের ‘দাঙ্গা’ পুরোপুরি অন্য রকম, পাঠক দেখতে পায়, দুটো ছেলে এবং একজন কোমর থেকে ছোরা বার করে লোকটার পেছনে বসিয়ে দেয়, তারপর বোঝা গেল দাঙ্গার সূত্রপাত। অজ্ঞাত এক ব্যক্তির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে গল্প এগিয়েছে, যে ব্যক্তিটি অশোকের পিতা, তারপর দুই ভাইয়ের মধ্যে যে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথোপকথন তা দাঙ্গার বিষয়ে অবগত করেছে, দাঙ্গা শুধু ক্ষয়ক্ষতিই করে না, সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে বিভেদ সৃষ্টি হয় না, একটা ক্ষত তৈরি করে দেয়, যে ক্ষত হয়তো জীবনে আর পূরণ হয় না। দাঙ্গার অভিজ্ঞতা নিয়ে নরেন্দ্রনাথ মিত্র-সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ-জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী-শওকত ওসমান-রশীদ করীম-আবদুল মান্নান সৈয়দ-শওকত আলী বা মাহমুদুল হক অথবা কায়েস আহমেদ প্রমুখ প্রচুর গল্প লিখেছেন, তাদের গল্পেও তার ছেঁড়ার যে বেদনা অনুভূত হয়, তার সঙ্গে সোমেনের দাঙ্গার বিষয়টি অন্য রকম। অজয় যখন কর্কশ কণ্ঠে বলে, তোমরা তো বলবেই, আমরা হিন্দুও নও, মুসলমানও নও, আমরা ইহুদির বাচ্চা নারে? অশোক হা-হা করে হেসে বলে, সার্চ হোক বা না হোক, তাতে উল্লাস করবারই বা কী আছে, দুঃখিত হবারই বা কী আছে, আসল ব্যাপার হলো অন্য রকম, দেখতে হবে এতে কার কতখানি স্বার্থ রয়েছে। দাঙ্গায় যে কার লাভ হয় তা তো কেউ বুঝতে পারে না কিন্তু ক্ষতি যাদের হয় তারা আর উঠে দাঁড়াতে পারে না। অশোকের বাবা আর ফিরে আসেনি, মায়ের মলিন মুখটা আরো করুণ হয়ে ওঠে, ফিসফিসিয়ে বলে, ‘তাছাড়া আজ আবার মাইনে পাবার দিন’। গল্পে দাঙ্গার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংকট এবং তা থেকে উদ্বেগের একটা চিত্র উঠে এসেছে। জীবনের অর্থ পরিষ্কার করবার দায়িত্ব হয়তো একজন লেখকের নয়, তিনি শুধু হাত দিয়ে দেখিয়ে দেবেন, পরবর্তী কাজটা করতে হবে সাধারণ জনতাকে, রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’। মানুষই পারে সমস্ত বাধানিষেধ ভেঙে একটা নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে, বিশ্বে যত দেশে দাঙ্গা হচ্ছে, তা সবই ফ্যাসিস্ট এজেন্টদের কাজ, সবাই বড়লোকদের দালাল, সাধারণ মানুষ শুধু বলি হয় এবং তাদের হাতের পুতুল হয়। পুতুলনাচের আড়ালে যে কুশীলবরা সুতা টেনে পুতুল নাচায় এবং কণ্ঠ চিকন করে কথা বলে, তা সবই দর্শক- শ্রোতাকে মুগ্ধ করতে, পুতুলনাচের আড়ালের আসল গল্পটা কেউই জানে না। মানুষ শুধু অন্যের প্ররোচনায় প্ররোচিত হয়ে দাঙ্গায় জড়ায়, কিন্তু ফলাফল শূন্য, মাঝখানে মুনাফা লুটে নেয় মহাজন, দাঙ্গা কখনো সুখ দেয় না, শান্তি দেয় না তার পরও শিক্ষার অভাবে মানুষ দাঙ্গায় নিজেকে সম্পৃক্ত করে ফেলে, হয়তো সেটা চরম মূর্খতা, যে মূর্খতার অভিশাপে মানুষ দাঙ্গার মতো নৃশংস কর্মকা-ে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে, হয়তো কা-জ্ঞান হারানো মানুষই এমন কাজ করতে পারে। সোমেন তার ‘দাঙ্গা’ গল্পে প্রতীকের মাধ্যমে চিরপরিচিত একটা নষ্ট ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।
সোমেনের গল্প বয়নের ভঙ্গি নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে সমালোচকরা বলেছেন, তার গল্প সহজ সরল এবং প্রতীকধর্মী। কথাটা সর্বাংশেই সত্য, সোমেনের গল্পে কোনো ঘোরপ্যাঁচ যেমন নেই, তেমনি ভাষাগত বা আঙ্গিকাশ্রয়ী কোনো জটিলতা নেই, যা গল্পকে পাঠকের কাছে দুর্বোধ্য লাগতে পারে, বর্তমানের তথাকথিত কথাশিল্পীরা যখন ভাষা-আঙ্গিক বা বিষয় নিয়ে নতুনত্ব এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে জটিলতার কসরত চালিয়ে যাচ্ছেন, যেমন দেশে বা বহির্বিশ্বে কিন্তু সোমেনের গল্পের মানুষগুলো তার চেনাজানা জগতের ভেতর দাঁড়িয়ে আধুনিকতাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে, বিষয়-ভাষা-আঙ্গিক সবই সেই চেনাজানা মুখের প্রকাশভঙ্গির মতোই সরল, গল্প পরিবেশনের স্টাইল বিশেষভাবে লক্ষণীয়, তার গল্পের কাহিনী শুরু হয় প্রায় যে কোনো স্থান থেকে, বাঁধাধরা কোনো ছকে নিজেকে আটকে রাখেননি, কাহিনী শুরু থেকেই সূচনা, তারপর ক্রমে গল্পধারার সঙ্গে এগিয়ে উপসংহারে নিটোলতা আর গভীরতা লাভ। ‘প্রত্যাবর্তন’ গল্পে দুই বন্ধুর দীর্ঘকাল পরে প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ দিয়ে গল্পটি এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ২৫ বছর পরে নিজ গ্রামে ফিরে আসে প্রশান্ত, অনেক পরিবর্তন চোখে পড়ে তার, তাদের বাড়ির ভগ্নদশা দেখে মন তার খারাপ হলেও কালু মিয়ার সঙ্গে একরাত্রে দেখা হলে সবই যেন ভুলে যায়, বাল্যকালের বন্ধু, অনেক স্মৃতি লেপ্টে আছে ওর সঙ্গে, পুরনো হলে বন্ধু সে তো বন্ধু, কালু মিয়া দরিদ্র কিন্তু এতটাই দরিদ্র যা প্রশান্ত ভাবতে পারেনি কখনো, ওর ছেলে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে, কালুও তো একটা দুর্ভিক্ষের কঙ্কালসার অস্থি নিয়ে দাঁড়িয়ে। গল্পে যে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হয়েছে তা উপমার মধ্যদিয়ে উজ্জ্বল বলা যায়। এখানে বলা উচিত মানুষের খাদ্য হরণ করছে পুঁজিপতিরা, ওরা কেড়ে খাচ্ছে দরিদ্রের খাদ্যের তালিকা। এভাবে বুর্জোয়াসমাজ প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষের রক্ত-মাংস খেয়ে ফুলে-ফেঁপে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে, আর নিম্নবিত্ত বা বিত্তহীন মানুষ মহাকালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষে মানুষে এই যে বিভেদ-বৈষম্য, তার শিকড় কিন্তু রোপিত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদের কোলে, যেখানে তাবৎ সম্পদ লুণ্ঠিত করে রাখা হয়েছে। এদিকে অসহায় নিঃস্ব সব সাধারণ মানুষ ধুঁকে ধুঁকে পিষ্ট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রত্যাবর্তন গল্পের মতো ‘ইঁদুর’ গল্পটিও প্রতীকধর্মী। এখানেও দরিদ্র মানুষের কথাটি বেশ উচ্চৈঃস্বরেই উঠে এসেছে, বুর্জোয়া শ্রেণী দিন দিন কিভাবে ইঁদুরের মতো কুরে কুরে আমাদের সমাজ-সংস্কার আর সভ্যতাকে নিঃশেষ করছে, তারই ইঙ্গিত সোমেন প্রতীকের মধ্যদিয়ে গল্পে তুলে ধরেছেন। অভাব-অভিযোগ মানুষের লালিত স্বপ্নকে বিবর্ণ বা বিনাশ করে ফেলে, নিম্নমধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত অথবা বিত্তহীনকে বুর্জোয়া বা পুঁজিবাদ দমিয়ে রাখে, তার রোষানলে দলিত-মথিত হতে হতে একদিন সে ইঁদুরের খাবারে পরিণত হয়। গল্পে সুকুমার এমন একটি চরিত্র, যার মা-বাবা, ভাই-বোন সবই আছে, আছে অভাব, স্বপ্ন হারানো এ অভাব তাকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, দিন দিন সংকুচিত করে, কিন্তু সে বাঁচার মতো বাঁচতে চায়, বর্তমানে সে আছে এবং পৃথিবীকে জানাতে চায় সে বাঁচবে বাঁচার মতো, তার স্বপ্ন-বাসনাগুলো প্রজাপতির মতো পেখম মেলতে চায়। কিন্তু প্রতিনিয়ত এই পরিবারের মানুষদের ঐ একটা বুর্জোয়া ইঁদুর তাড়া করে বেড়ায়, সুকুমার আড়ষ্ট থাকে ওর মা ভয়ে তটস্থ সর্বদা, একটা শঙ্কা একটা অপরাধবোধ তাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, অভাবী পরিবারটি বাড়তি খরচা হিসেবে একটা ইঁদুর ধরার কল কেনার চিন্তাও কল্পনা করতে পারে না। তার পরও তারা ইঁদুরের সঙ্গে যুদ্ধ করে, সাম্রাজ্যবাদের পতন না হওয়া অবধি ইঁদুরের যে উৎপাত, তা হয়তো কখনো নিবৃত্ত হবে না। অভাবে মানুষ পুষ্টিহীন হচ্ছে, অনাহারে দিন দিন তার শরীরের মাংস ঝরে যাচ্ছে, জীবন থেকে তাবৎ স্বপ্ন-বাসনা একটু-একটু দূরে সরে যাচ্ছে, ‘ইঁদুর’ গল্পে এই বোধ সোমেনের চিন্তাকে সুদূরপ্রসারিত করেছে। গল্পটির পশ্চাৎপদ নিয়ে কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত যে বিবরণ দিয়েছেন তা হলো ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরের বড়দিনে সোমেন চন্দ ‘ইঁদুর’ গল্পটি নিয়ে আসে, তিনি বলেছেন, ‘ইঁদুর যখন লেখা হয় তখন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন, সে সময় নানা পর্বে দেশজুড়ে স্বাধীনতার জন্য চলছিল সক্রিয় আন্দোলন, গল্পে সংসারে অভাব-অনটনের চিত্র যে শিল্পরূপ পেয়েছে, তার উপাদানগুলোর কিছু অংশ সে সংগ্রহ করেছে তার পারিবারিক জীবনের প্রতিদিনের পরিবেশ থেকে।’ কুলাঙ্গার পুঁজিবাদী সমাজ রক্তচোষা জোঁকের মতো নিঃস্ব-দরিদ্র জনগোষ্ঠীর গায়ের রক্ত খেয়ে-শুষে যেভাবে একেকটা ঈগল বা শকুন হচ্ছে, তার ফলে বিত্তহীনেরা কলুর বলদই থেকে যাচ্ছে, ইঁদুর গল্পে সেই চেতনার ইঙ্গিত সুস্পষ্ট।
সোমেন চন্দের সাহিত্যের মূল যে বাণী তা হলো বুর্জোয়া বা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারলে রক্ষা নেই। তাই জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঙ্গার মতো কালবিষকে যেমন উপড়ে ফেলতে চেয়েছেন, সত্যবতীর বিদায়ের ভেতর দিয়ে সমাজের কুসংস্কার আর খারাপটাকে সমূলে বিনাশ করতে তার অভিপ্রায়ের ঘাটতি নেই, আবার ইঁদুরের উৎপাত থেকে সবাইকে কোমর বেঁধে নামতে বলেছেন, সোমেন একদিকে ছিলেন সামপ্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আবার বুর্জোয়াবাদের বিরুদ্ধে। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সুসমৃদ্ধ একটা সমাজ গঠন করার প্রত্যয় তার লেখনীর মধ্যে ব্যাপকভাবে ফুটে উঠেছে চিরন্তন।
একটা সুখী-সমৃদ্ধ সমাজের স্বপ্ন যার অস্থিমজ্জায়, অথচ জীবনভর অভাব-অনাচারের সঙ্গে এককভাবে সংগ্রাম করেছেন, জীবন যেখানে বহমান নদীর মতো, সেখানে দাঁড়িয়ে সোমেন হেঁটেছেন একটা আলো-আঁধারির মধ্যে। একের পর এক উপহার দিয়েছেন জীবনঘনিষ্ঠ আশাবাদের লেখা। তার গল্পের প্লটে বাংলা ভাষাভাষী পাঠক ভেসে গেছে, সময় এবং চাহিদার রচনার ধারায় স্বভাবত ভিন্ন আঙ্গিকের সেই রচয়িতার নামই হয়তো সোমেন চন্দ।
২/৪/২০১৭/২০/সা/ফা/